Spread the love

মাত্র ছয় বছরের চাকরিজীবনে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ফেনী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ড্রাফটম্যান শাহিন আলম। ২০১৮ সালে ২১,৪৭০ টাকা বেতন স্কেলে চাকরি শুরু করা এই কর্মকর্তা এখন বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি এবং পরিবহন ব্যবসার মালিক। দুর্নীতির অভিযোগে একাধিকবার বদলির মুখোমুখি হয়েছেন শাহিন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় তদন্ত, বিভাগীয় মামলা ও দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগও করা হয়েছে।
শাহিন আলম কে? :- কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের শুভপুর ইউনিয়নের তেলিহাটি গ্রামের এক দরিদ্র বাদাম বিক্রেতার সন্তান শাহিন আলম। পরিবারে কৃষিজমি না থাকলেও আজ তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় শত শত শতক জমির মালিক। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, রেলপথমন্ত্রীর সুপারিশে চাকরিতে যোগ দিয়েই তাঁর ভাগ্য বদলে যায়। চাকরির শুরু এবং দুর্নীতির সূত্রপাতঃ ২০১৮ সালের নভেম্বরে কুমিল্লার বরুড়ায় প্রথম পদায়ন পান সহকারী প্রকৌশলী পদে (ড্রাফটম্যান)। দ্রুতই তিনি জমি কিনে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরি করেন। এরপর একে একে বদলি হন লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, পঞ্চগড়সহ ছয় জেলায়।
ভুয়া বিল, সিন্ডিকেট ও ঠিকাদারি সিন্ডিকেটঃ লাকসামে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় সরকারি কাজের মান নিয়ন্ত্রণে ধোঁকা দেওয়া হয়। ভুয়া বিল ও ভাউচার দেখিয়ে একাধিক প্রকল্পে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেন শাহিন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩৬২টি গভীর নলকূপ স্থাপন দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৮টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নলকূপ না বসিয়েও ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ—এসব তথ্য পাওয়া গেছে জনস্বাস্থ্য কার্যালয়ের নথি থেকে।
বিলাসবহুল সম্পত্তির পাহাড়ঃ নিম্নোক্ত সম্পদগুলো শাহিন আলমের নামে বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে: ১/জমি: কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার জমি, চান্দিনায় ৩ কোটির বেশি মূল্যের জমি, কাদৈর বাজারে ৪০ শতক জমি (মূল্য ২.৮ কোটি)২/ফ্ল্যাট: কুমিল্লার বাগিচাগাঁও ও ঢাকার খিলগাঁওয়ে ২টি ফ্ল্যাট (মূল্য প্রায় ২.৫ কোটি টাকা) ৩/ বাস: ইফাদ মোটরস থেকে কেনা ৫টি স্লিপার কোচ (প্রতিটির মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা)। ৪/ পরিবহন ব্যবসা: আরও ৩টি স্লিপার কোচ, ১১টি ডাম্প ট্রাক ও ১১টি এক্সকাভেটর (মোট মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা)।৫/ প্রাইভেট কার: একটি টয়োটা প্রিমিও (মূল্য ৪৫ লাখ) ৬/ ব্যাংক এফডিআর: কয়েক কোটি টাকা নামে-বেনামে এফডিআর রয়েছে বলে জানা গেছে বিদেশে ব্যবসাঃ দুবাইয়ে ব্যবসার অভিযোগও উঠেছে। রাজনৈতিক যোগাযোগ ও ছত্রছায়াঃ তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক এবং স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা মোহব্বত আলীর আশীর্বাদে এই দুর্নীতির বিস্তার হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। চৌদ্দগ্রামের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম জানান, ১৮ কোটি টাকার ড্রেন নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়ম করে বিল তুলেই উধাও হয়ে যান শাহিন।
আদালত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপঃ ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর একজন ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেন। একই বছর ২১ জুলাই শাহিন আলমের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার মামলাও হয় যাত্রাবাড়ীর একটি ঘটনায়। ফেনী জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল হক বলেন, “তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে এবং তদন্ত প্রক্রিয়াধীন।”
হুমকি ও ঘুষের প্রস্তাবঃ এই প্রতিবেদনের জন্য শাহিন আলমের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিবেদককে হুমকি দেন তিনি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মচারীর ঘাড়ে যদি শতকোটি টাকার অভিযোগ ওঠে, তবে প্রশ্ন ওঠে পুরো কাঠামো নিয়েই। এখন দেখার বিষয়, দুর্নীতির এই বিস্ময়কর কাহিনির শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকে এবং কতটা কার্যকরভাবে তদন্ত ও বিচার হয়।

By তালাশ বাংলা ডেস্ক

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ আক্কাস আল মাহমুদ হৃদয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *