কুমিল্লার শহর ঘেঁষে বয়ে চলা গোমতী নদীর উত্তরে, সীমান্তবর্তী মাঝিগাছা গ্রাম। এই গ্রামেই প্রায় ৩০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক রহস্যময় ও করুণ ইতিহাসঘেরা মসজিদ—যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘নটীর মসজিদ’ বা ‘বাইজি মসজিদ’ নামে। এই মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক নারীর জীবনগাঁথা, যে এক সময়ের রাজদরবার কাঁপানো শ্রেষ্ঠ বাইজি ছিলেন, আর শেষ জীবনে হয়ে উঠেন অনুশোচনায় ক্লান্ত এক নারী—নূরজাহান।নূরজাহানের জীবনের করুণ মোড় মাঝিগাছার কিশোরী নূরজাহান সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে কলাগাছের ভেলায় ভেসে পড়েন নদীতে। সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন ত্রিপুরার মহারাজার রাজদরবারের প্রধান বাইজি মেনেকা। পরে রাজপ্রাসাদে নিয়ে তাঁর চিকিৎসা ও পরিচর্যা করা হয়। মেনেকার কাছ থেকেই নূরজাহান নাচ-গান শিখে হয়ে ওঠেন রাজদরবারের শ্রেষ্ঠ বাইজি। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজদরবার থেকে অবসর নিতে হয় তাঁকে। ত্রিপুরার মহারাজা তাঁকে অবসরে পাঠিয়ে দেন এবং কুমিল্লার মাঝিগাছা গ্রামে কয়েক একর জমি, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার দান করেন। এরপর তিনি নিজেকে জমিদারের বিধবা স্ত্রী পরিচয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করেন।অনুশোচনায় নির্মিত মসজিদ নূরজাহান গ্রামের দরিদ্র মানুষদের নানা রকম সাহায্য করতেন, তবে অতীত জীবনের জন্য সবসময় অনুশোচনায় ভুগতেন। একসময় এক মাওলানার শরণাপন্ন হন এবং তাঁর পরামর্শে একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন—আশা ছিল, আল্লাহ তাঁর পাপ ক্ষমা করবেন। গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ। নিজ খরচে জমি ও অর্থ দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করান নূরজাহান। নির্ধারিত হয় প্রথম নামাজের দিন। ইমামতি করতে আসেন সেই মাওলানা সাহেব। মুসল্লিরাও সমবেত হন।
অভিশপ্ত অধ্যায়ের শুরু নামাজ শুরুর আগে মাওলানা সাহেব তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন নূরজাহানের অতীত জীবনের কথা। সেই সঙ্গে জানান, এই মসজিদ একজন বাইজির অর্থে নির্মিত। সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লিরা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন,“আমরা এ মসজিদে নামাজ পড়ব না, এটি নটীর মসজিদ!” এবং সবাই চলে যান মসজিদ চত্বরে নামাজ না পড়েই। এরপর আর কোনো দিন উচ্চারিত হয়নি আজান, হয়নি নামাজ, ওঠেনি “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি। সেই থেকে মসজিদটি পরিচিত হয়ে ওঠে ‘নটীর মসজিদ’ বা ‘বাইজি মসজিদ’ নামে।
নূরজাহানের শেষ জীবন এই অপমান ও প্রত্যাখ্যানে ভেঙে পড়েন নূরজাহান। তিনি বাকি জীবন কাটান একাকিত্বে। কেউ বলেন, তিনি আত্মহত্যা করেন। আবার কেউ বলেন, চুপিচুপি দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। স্থানীয়দের মতে, মসজিদের পশ্চিম পাশে তাঁর কবর রয়েছে, আর সেই স্থানটি আজও ব্যবহৃত হয় কবরস্থান হিসেবে।
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ মসজিদ প্রায় ২৫০-৩০০ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রহস্যময় মসজিদ। ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিভেদ কীভাবে একজন নারীর তওবা ও অনুশোচনাকেও ঠেলে দিতে পারে চরম অবহেলায়—তারই নীরব স্মারক হয়ে রয়ে গেছে ‘নটীর মসজিদ’।