মো. মোসলেম উদ্দিন—৭৮ বছরের এক বৃদ্ধ, জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও যিনি হাল ছাড়েননি। জন্ম কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশীমূল দক্ষিণ পাড়ায়, পিতার নাম মৃত ইউসুফ আলী খান। ১৯৭৪ সালে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১ সেক্টরে, চিড়িয়াখানা রোডের বক্স নগরে। সেখান থেকেই শুরু হয় তার কঠিন জীবনের লড়াই। ১৯৮০ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রহিমা খাতুনের সঙ্গে। সংসারে প্রথমে দুইটি সন্তান জন্ম নেয়, কিন্তু ভাগ্য নির্মম—দুই সন্তানই মারা যায়। শোকের ছায়া কাটিয়ে ১৯৮৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয় তাদের তৃতীয় সন্তান,নাম রাখেন নবী হোসেন তুইন। এই সন্তানই ছিল তাদের জীবনের একমাত্র আশার আলো। দীর্ঘ ২০ বছর ঢাকায় বাসচালকের পেশায় নিয়োজিত ছিলেন মোসলেম উদ্দিন।

পরে ২০০০ সালের দিকে একটি ছোট চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। এদিকে তুইনও বড় হয়ে পরিবারের হাল ধরেন। ২৫ বছর বয়সে সে প্রাইভেটকার চালানো শুরু করে এবং কিছুদিন পর বিয়ে করে সাহেনা আক্তার নামে এক তরুণীকে। তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান সাবিনা আক্তার (বর্তমানে ১৪ বছর) এবং এক পুত্র সন্তান তানজিম (বর্তমানে ৭ বছর)।
আজও চা দোকানদার মোসলেম উদ্দিনের সাথে রয়েছে নিহত ছেলের একটি ছবি। দোকানে বসে মাঝে মাঝে সে ছবিটির দিকে চেয়ে চোখের জল ফেলেন চুপচাপ। জীবনের অনেক কিছুই তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু হার মানেননি। তার জীবনগল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষ যত কষ্টই পাক, বাঁচার আশা আর সাহস থাকলে সবই সম্ভব।
কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে ২০২০ সালের ২৪ জানুয়ারি। সেদিন ঢাকা মিরপুরে সিটি কর্পোরেশনের এক বেপরোয়া ময়লার গাড়ির নিচে পড়ে গুরুতর আহত হয় তুইন। হাসপাতালে নেওয়ার পরই মারা যায় সে। সন্তানহারা পিতা মোসলেম উদ্দিন ভেঙে পড়েন। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মীমাংসা হিসেবে ২ লক্ষ টাকা দেয়। সেই টাকা এবং নিজের জমানো ১ লক্ষ টাকা নিয়ে হাসপাতালে গেলে, দুর্ভাগ্যক্রমে ছিনতাইকারীদের হাতে সব হারান তিনি। সব হারিয়ে নিঃস্ব মোসলেম উদ্দিন ২০২১ সালে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। বুড়িচং সদরে একটি ভাড়া বাসায় উঠেন এবং দক্ষিণ বাজার তালাশ বাংলা অফিস সংলগ্ন ভূঁইয়া মার্কেটের নিচতলায়, সিঁড়ির নিচে আবার একটি চায়ের দোকান দেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও এই বৃদ্ধ তার শেষ রোজগার দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। মার্কেটের টিন দোকানদার নারায়ণ তালাশ বাংলাকে বলেন,তাকে আমরা একটি দোকান ভাড়া নিয়ে দেই।মার্কেটের মালিককে মাসে ২ হাজার টাকা ভাড়া দেন তিনি। চা- বিস্কুট বিক্রি করে কোনোরকম সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। স্ত্রী,ছেলের বউ,দুই নাতি-নাতিনকে নিয়ে তার বসবাস। প্রায় সময় তিনি অসুস্থ থাকেন দোকানে কম আসতে দেখা যায়। এই দোকান থেকে যে টাকা আয় করে তা দিয়ে দোকানের ভাড়া ও সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয় তার। স্থানীয় সংবাদ কর্মী শরীফ সুমন তালাশ বাংলাকে জানায়,আমাদের অফিসের নিচ তলায় মোসলেম উদ্দিনের চায়ের দোকান। তার দোকানে আমার প্রায় সময় যাতায়াত হয় এবং নাস্তা করি। মাঝে মধ্যে তিনি দোকান বন্ধ রাখেন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি অসুস্থ। যার কারণে দোকান চালাতে তার অনেক কষ্ট হয়।চা বিক্রির টাকা ছাড়া তাকে অতিরিক্ত টাকা দিলে নেয় না। আজও চা দোকানদার মোসলেম উদ্দিনের সাথে রয়েছে নিহত ছেলের একটি ছবি। দোকানে বসে মাঝে মাঝে সে ছবিটির দিকে চেয়ে চোখের জল ফেলেন চুপচাপ। জীবনের অনেক কিছুই তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু হার মানেননি। তার জীবনগল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষ যত কষ্টই পাক, বাঁচার আশা আর সাহস থাকলে সবই সম্ভব।