Spread the love

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে মাথা থেঁতলে হত্যার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে পুলিশ। নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ড এবং তার পরের ঘটনাপ্রবাহের বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। সেসব দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছে মানুষ, তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অতীতের ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়ায় একের পর এমন নৃশংসতা ঘটছে। বুধবার বিকালে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের সামনে প্রকাশ্যে কংক্রিট বোল্ডার দিয়ে শরীর ও মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয় ভাঙারি ও পুরনো তারের ব্যবসায়ী মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে। পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন, ওই হত্যাকাণ্ডে যাদের অংশ নিতে দেখা গেছে, এবং নেপথ্যে যাদের নাম আসছে, তারা সবাই পূর্ব পরিচিত। একসময় তাদের কয়েকজন সোহাগের ব্যবসার সহযোগী ছিলেন। ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধে এমন ভয়ঙ্করভাবে কাউকে হত্যা করা হতে পারে, তা পরিচিতজনদের ধারণারও বাইরে। এ ঘটনায় যৌথ বাহিনী মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন নামে দুজনকে এবং র‌্যাব আরও দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। মহিনকে পাঁচ দিন ও রবিনকে ২ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন। মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিন। ওই এলাকার একজন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসায়ী বলছেন, পুরনো তারের ব্যবসার একটি বড় সিন্ডিকেট সেখানে রয়েছে, যার নিয়ন্ত্রণ করতেন সোহাগ। গ্রেপ্তার মহিন তার দলবল নিয়ে ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। “সেই চেষ্টায় তারা সোহাগের গোডাউনে তালা মেরে দেয়। তাদের মধ্যে এটা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়। জড়িতদের কয়েকজন স্থানীয় যুবদলের রাজনীতিতে জড়িত। সোহাগও এক সময় যুবদল করতেন।” এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার ১৯ আসামির মধ্যে দুজন যুবদলের কেন্দ্রীয় ও মহানগরে নেতা। শুক্রবার সন্ধ্যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই দুই নেতাকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী যুবদল। যুবদলের কেন্দ্রীয় সহ দপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভুঁইয়া স্বাক্ষরিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গত ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালের মূল ফটকে জনসম্মুখে মোহাম্মদ সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ী যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। “সেই মামলার আসামি যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকিকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ দল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।” যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম নয়ন ‘ইতোমধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন’ বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এ ঘটনার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো ধরনের ‘শৈথিল্য’ না দেখিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুবদল। নিহত মো. সোহাগ নিহত মো. সোহাগ ওই মামলায় দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মফিজুল ইসলাম বলেন, “আমাকে অনেকের কাছেই এই প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে যে কেন এই নৃশংসতা। আমি এই প্রশ্নের জবাব এখনো দিতে পারছি না। “আমরা যাদের গ্রেপ্তার করেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এখনো কনক্লুসিভলি বলার মত তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা শুধু জানি যে সেখানে নৃশংস একটা ঘটনা ঘটেছে। অনেকের কাছে ভিডিওটা আছে। আমরা জানার চেষ্টা করছি এই হত্যার মোটিভটা কী, কেন এভাবে হত্যা করা হল।” ঢাকা মহানগর পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিহত সোহাগের বড় বোন কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ভিডিও সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১) এবং তারেক রহমান রবিনকে (২২) গ্রেপ্তার করেছে। রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। একই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে র‍্যাব আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “প্রাথমিকভাবে জানা যায়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এই ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সাথে জড়িত অন্যান্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।” কেন এই নৃশংসতা নব্বই দশকের শুরু থেকে ঢাকায় অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা করে আসছেন কামরুল হাসান। তিনি বলেন, “রাষ্ট্র ব্যবস্থা যখন ফাংশন করে না, আইন-শঙ্খলা বাহিনী যখন তার দায়িত্বটা পালন করে না তখন মানুষ মনে করে এই বিচারটা তাকেই করতে হবে। তখন সে যা খুশি তা করে। আবার এরকম একটা ঘটনার পর যখন তার বিচার হয় না। যখন মানুষ জানে যে তার কিছু হবে না, তখন এরকম ঘটনা একটার পর একটা ঘটতে থাকে।” বর্তমানে দৈনিক আজকের পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামরুল হাসান বলছেন, “যদি এরকম হত একটা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে তাহলে আর দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটানোর সাহস হত না তাদের। তারা যেহেতু জানে তাদের কিছু হবে না, সেজন্য ঘটেই চলেছে এ ধরনের ঘটনা। এটার জন্য দরকার আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থাটা ঠিক করা।” ওই ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠেছেন অপরাধ গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হকও। তিনি বলেন, “এরকম নৃশংস প্রক্রিয়ায় কোন মানুষকে হত্যা করা, হত্যার পরেও তার শরীরে আঘাত করা, শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করা- এরকম শিউরে ওঠা বর্বরতা আমরা দেখলাম।” এই গবেষকের ভাষ্য, “সমাজে চলতে গিয়ে নানা ধরনের বিরোধ মানুষের মধ্যে থাকতে পারে। সেটা রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা সম্পর্ক, পারিবারিক প্রেক্ষাপটসহ নানা ধরনের বিরোধ থাকতেই পারে। বিরোধ যে শুধু বাংলাদেশেই আছে ব্যপারটা তো এরকম না। সকল সমাজেই বিরোধ থাকে। সেটা তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বা আইনগনভাবে সুরাহা করে বা প্রশমিত করে। “সম্প্রতি, বিশেষ করে ৫ অগাস্টের পর যে ধরনের সংঘাত-সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার একটা প্যাটার্ন আছে। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে সরকার কীংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছে, যে সংঘাত-সহিংসতাপ্রবণ মানুষ এসব থেকে বিরত থাকবে? আমরা এরকম একটা ব্যবস্থাও দেখি না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব অপরাধীর বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বড় একটা ঘাটতি আছে।“ তিনি বলেন, “আমরা হত্যা করে কয়েক টুকরো করার ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি। কারণ মানুষের মধ্যে ভয় নেই, অপরাধপ্রবণ মানুষ ভাবছে, এসব ঘটনায় তাদের বিচার নাও হতে পারে।” তাহলে সমাধান কোথায়? ড. তৌহিদুল বলছেন, “একটা জাদু আছে, সেটা হচ্ছে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ। আইনের শাসনের কোনো বিকল্প এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এই মুহূর্তে জাদুর কাঠির মত কাজ করবে যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদি এদের দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনা যায় এবং সেই বিচারকে দৃশ্যমান করা যায়, তাহলে পরিস্থিতি পাল্টাবে।”

By তালাশ বাংলা ডেস্ক

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ আক্কাস আল মাহমুদ হৃদয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *