ইসরা ও মিরাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। মুমিনের ভক্তি , বিশ্বাস,আবেগ এবং অনুভূতির শেকড় গভীরভাবে মিশে আছে যার সঙ্গে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওহীদ ও ঈমানের দাওয়াতে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন। কাফেরদের নির্মম অত্যাচার ও অবর্ণনীয় বাক্যবাণে তিনি বিধ্বস্ত। মুষ্টিমেয় কিছু মুসলিম জুলুম-অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট। তবুও হৃদয়ে তারা ঈমানের আলো জ্বেলে রেখেছেন। এভাবেই এগিয়ে চলছে ইসলামের প্রচার-প্রসার। আশ্রয় ও শান্তনার বিরাট দুটি বৃক্ষ একে একে চলে গেছেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে। খাজা আবু তালিব ও উম্মুল মুমিনীন খাদীজাতুল কুবরা রা.। আশা ছিল, তায়েফবাসী যদি কথাগুলো একটু মেনে নেয়! তাওহীদের দাওয়াত কবুল করে! না, তারাও সাড়া দিল না। শুধু কি তাই, নির্দয়ভাবে ক্ষতবিক্ষত করল প্রাণপ্রিয় নবীজীকে। এমন মুহূর্তে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ডেকে নিলেন প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঊর্ধ্বজগতে। রাতের এক খণ্ডে, জিবরাঈলকে পাঠিয়ে, বুরাকে চড়িয়ে। কোরআনের ভাষায়-পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতের একটি অংশে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু শোনেন এবং সব কিছু জানেন। -সূরা ইসরা (১৭) : ১ বস্তুত ইসরা হচ্ছে, মক্কা মুকাররমা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণের সেই পর্বটুকু, যা রাতের একটি অংশে সংঘটিত হয়েছিল। আর মিরাজ হচ্ছে সেখান থেকে ঊর্ধ্বজগৎ পরিভ্রমণের সেই বিস্তৃত অধ্যায়।আল্লাহ তায়ালা সূরা নাজমে বলেন,বস্তুত সে তাকে (হযরত জিবরাঈল আ.-কে) আরও একবার দেখেছে। সিদরাতুল মুনতাহা (সীমান্তবতীর্ কুলগাছ)-এর কাছে। তারই কাছে অবস্থিত জান্নাতুল মা’ওয়া। তখন সেই কুল গাছটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেই জিনিস, যা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। (রাসূলের) চোখ বিভ্রান্ত হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি। (অর্থাৎ দেখার ব্যাপারে চোখ ধোঁকায় পড়েনি এবং আল্লাহ তায়ালা তার জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, তিনি তা লংঘনও করেননি যে, তার সামনে কী আছে তা দেখতে যাবে।) বাস্তবিক পক্ষে, সে তার প্রতিপালকের বড়-বড় নিদর্শনের মধ্য হতে বহু কিছু দেখেছে। -সূরা নাজম (৫৩) : ১৩-১৮ ইসরা ও মিরাজের ব্যাপারে কোরআনের বর্ণনায় সংক্ষেপে এতটুকুই বলা হয়েছে। আর বিস্তারিত এসেছে হাদীসের পাঠগুলোতে। সীরাত, সুন্নাহ এবং তারীখের নির্ভরযোগ্য সূত্রে রয়েছে এর বিশদ বিবরণ।
পবিত্র কালামুল্লাহর এই আলোচনা থেকে যে বিষয়গুলো সামনে আসে তা হচ্ছে- ১. আল্লাহ তায়ালা পবিত্র সত্তা। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেকের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর শক্তি ও সক্ষমতা। তিনি তার বান্দাকে রাতে পরিভ্রমণ করিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সর্ব প্রকার সংশয় ও দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ২. ইসরা ও মিরাজ রাতে সংঘটিত হয়েছিল। ৩. মক্কা মুকাররমা থেকে নবীজীকে প্রথমে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে নবীজী ঊর্ধ্বজগতে আরোহিত হন। ৪. বাইতুল মুকাদ্দাস ও তার চারপাশের এলাকা বরকতময়। ৫. আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিরাজের নিয়ামত দান করেছেন তিনি তার বড় বড় কুদরত ও নিশানা দেখাবেন বলে। ৬. মিরাজের বিষয়টি এমন, যা সাধারণ বোধগম্য বিষয় নয়। এটা কেবলই মহান রবের কুদরতের কারিশমা। মাখলুকের সীমাবদ্ধ হিসাব-নিকাশ সে পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম নয়… ইত্যাদি। এ তো গেল কোরআন কারীমের বিবরণ। সেখানে ইসরা ও মিরাজের বিবরণ এসেছে সংক্ষেপে। বিস্তারিত বিবরণ এসেছে হাদীস শরীফে।
কিছু দীর্ঘ হাদীসে মিরাজের মোটামুটি বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। আর কিছু হাদীসের বিভিন্ন পাঠ থেকে মিরাজের টুকরো টুকরো বর্ণনা পাওয়া যায়। সে হাদীসগুলো সামনে রেখে মিরাজের ঘটনা নিম্নরূপ- হিজরতের পূর্বের কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একরাতে শুয়ে ছিলেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন। চোখদুটো মুদে এসেছে বটে, তবে দিল ছিল জাগ্রত। এরই মাঝে আগমন করলেন হযরত জিবরাঈল আ.। তিনি নবীজীকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন যমযমের নিকট। একটি স্বর্ণের পেয়ালা আনা হল। তা ছিল ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ। তাতে যমযমের পানি। জিবরাঈল আ. নবীজীর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করলেন। বের করে আনলেন নবীজীর হৃদয়। যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে আবার প্রতিস্থাপন করে দিলেন যথাস্থানে। ঈমান ও হিকমতে পূর্ণ করে দেওয়া হল নবীজীর কলব। এরপর আনা হল নবীজীকে বহন করার জন্য সওয়ারী। প্রাণীটি গাধার চেয়ে বড়, ঘোড়া থেকে ছোট। নাম বুরাক। রং সাদা। এটা এতটাই ক্ষিপ্রগতির যার একেকটি কদম পড়ে দৃষ্টির শেষ সীমায় গিয়ে। এভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহূর্তেই পৌঁছে গেলেন বাইতুল মুকাদ্দাসে। বুরাক বেঁধে রাখা হল পাথর ছিদ্র করে। যে পাথরে অপরাপর নবীগণ নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন। নবীজী সেখানে দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। নামায পড়ে বের হওয়ার সময় জিবরাঈল আ. নবীজীর সামনে দুটি পেয়ালা পেশ করলেন। একটি দুধের অপরটি শরাবের। নবীজী দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলেন। জিবরাঈল আ. বললেন, আপনি (দ্বীনের) স্বভাবসিদ্ধ বিষয়টি নির্বাচন করেছেন। নবীজী মদের পেয়ালা নেওয়ার পরিবর্তে দুধের পেয়ালা গ্রহণ করায় জিবরাঈল আ. বলেন, আপনি যদি মদের পেয়ালা নিতেন তাহলে আপনার উম্মত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৯৪) এরপর শুরু হল ঊর্ধ্বজগতের সফর। জিবরাঈল নবীজীকে নিয়ে চললেন। প্রথম আসমানে গিয়ে দস্তক দিলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, কে? বললেন, জিবরাঈল। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞাসা করা হল, তার কাছে কি আপনাকে পাঠানো হয়েছে? বললেন, হাঁ। এরপর নবীজীকে সম্ভাষণ জানানো হল- মারহাবা, উত্তম আগমনকারীর আগমন ঘটেছে! খুলে দেওয়া হল নবীজীর জন্য আসমানের দরজা। নবীজী প্রথম আসমানে গেলেন। সেখানে ছিলেন হযরত আদম আ.। জিবরাঈল পরিচয় করিয়ে দিলেন। নবীজী হযরত আদমকে সালাম বললেন। বাবা আদম জবাব দিলেন। নবীজীকে সাদর অভিবাদন জানালেন- মারহাবা, নেককার পুত্র ও নেককার নবী। হযরত আদম আ. নবীজীর জন্য দুআ করলেন। এরপর নবীজী উঠতে থাকলেন দ্বিতীয় আসমানের দিকে। সেখানেও দরজা খুলতে প্রথম আসমানের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। এরপর নবীজীকে ইস্তেকবাল করা হল। নবীজী সেখানে দেখতে পেলেন দুই খালাত ভাই হযরত ঈসা আ. ও হযরত ইয়াহইয়া আ.-কে। তাদের সাথে নবীজীর সালাম বিনিময় হল। তারা নবীজীকে স্বাগত জানালেন- মারহাবা, আমাদের পুণ্যবান ভাই এবং সজ্জন নবী। তারা নবীজীর জন্য দুআ করলেন। এরপর নবীজীকে তৃতীয় আসমানের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেও দুই আসমানের মতো জিজ্ঞাসাবাদ হল এবং নবীজীকে স্বাগত জানানো হল। সেখানে গিয়ে দেখলেন হযরত ইউসুফ আ.। হযরত ইউসুফের সাথে নবীজীর সালাম ও কুশল বিনিময় হল। নবীজী বলেন, হযরত ইউসুফকে যেন দুনিয়ার অর্ধেক সৌন্দর্য ঢেলে দেওয়া হয়েছে! এরপর চললেন চতুর্থ আসমানের দিকে। সেখানেও পূর্বের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। স্বাগত-সম্মান জানানো হল। সেখানে হযরত ইদ্রিস আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। সালাম ও কুশল বিনিময় হল। হযরত ইদ্রিস আ. নবীজীর জন্য দুআ করলেন। এরপর চললেন পঞ্চম আসমানের দিকে। সেখানে হযরত হারূন আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। এরপর চললেন ষষ্ঠ আসমানের দিকে। সেখানেও পূর্বের পর্বগুলোর মতো জিজ্ঞাসা করা হল। নবীজীকে অভিনন্দন জানানো হল। সেখানে দেখা হল হযরত মূসা আ.-এর সাথে। হযরত মূসা আ. নবীজীকে খুব ইস্তেকবাল করলেন। এরপর নবীজী সপ্তম আসমানের দিকে উঠতে থাকেন। সেখানে দেখা হল হযরত ইবরাহীম আ.-এর সাথে। জিবরাঈল আ. পরিচয় করিয়ে দিলেন। নবীজী হযরত ইবরাহীম আ.-এর সাথে সালাম বিনিময় করলেন। নবীজী বলেন, হযরত ইবরাহীম আ. তখন বাইতুল মামুরে হেলান দিয়ে ছিলেন। বাইতুল মামুর, যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা আসে। এরপর এই সত্তর হাজার আর ফিরে আসে না। এভাবে প্রতিদিন সত্তর হাজার করে ফেরেশতাদের নতুন নতুন কাফেলা আসতে থাকে। তারপর নবীজীকে নিয়ে যাওয়া হল সিদরাতুল মুনতাহার দিকে। সেই কুল বৃক্ষের একেকটি পাতা হাতির কানের মতো। আর একেকটি ফল মটকার মতো বড় বড়। যখন ওটাকে আল্লাহর বিধান আচ্ছন্ন করে নিল তা পরিবর্তিত হয়ে গেল। সৃষ্টির কারো সাধ্য নেই তার সৌন্দর্যের বিবরণ দেবার। জিবরাঈল বললেন, এটা সিদরাতুল মুনতাহা। এখানে চারটি নহর। দুটি অদৃশ্য আর দুটি দৃশ্যমান। নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, দৃশ্যমান নদী দুটি কোন গুলো? জিবরাঈল বললেন, অদৃশ্যমান দুটি জান্নাতে। আর দৃশ্যমান দুটি হল নীল নদ ও ফুরাত নদী। এরপর আল্লাহ তায়ালা নবীজীর প্রতি যে ওহী পাঠানোর পাঠালেন। দিনরাতে উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিলেন। নবীজী আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাতের এ হাদিয়া নিয়ে ফেরত আসছিলেন; এর মধ্যে দেখা হযরত মূসা আ.-এর সাথে। হযরত মূসা আ. জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ আপনার উম্মতের জন্য কী দিয়েছেন? নবীজী বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। হযরত মূসা বললেন, আপনার উম্মত রাত-দিনে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায পড়তে পারবে না। আপনার আগে আমি উম্মত চালিয়ে এসেছি। আপনি আল্লাহর কাছে গিয়ে কমিয়ে আনেন। নবীজী সে মতে আল্লাহর কাছে গিয়ে কম করে দেওয়ার দরখাস্ত করলেন। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। নবীজী তা নিয়ে ফেরত আসছিলেন। আবার হযরত মূসা আ.-এর সাথে দেখা হল। বললেন, আপনার উম্মত তা পারবে না। আপনি আরো কমিয়ে আনুন। নবীজী আবার আল্লাহর কাছে গিয়ে আগের মতো দরখাস্ত করে আরো পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে আনলেন। নবীজী বলেন, এভাবে আমি আল্লাহ ও মূসার মাঝে আসা-যাওয়া করতে থাকি। শেষবার আল্লাহ বলেন, মুহাম্মদ! এই হল দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। প্রত্যেক নামাযের বিনিময়ে দশ নামাযের সাওয়াব। এভাবে বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সওয়াব পাবে। কেউ কোনো ভালো কাজের ইচ্ছা করবে কিন্তু করতে পারবে না, তার জন্যও নেকী রয়েছে। এক নেকী। আর যদি ভালো কাজটি করে তাহলে তার জন্য দশ নেকী। আর কেউ কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করলে কোনো গুনাহ লেখা হবে না। তবে তা করে বসলে একটি গুনাহ লেখা হবে। নবীজী এ সওগাত নিয়ে ফেরত আসছিলেন। হযরত মূসার সাথে দেখা হল। মূসা আ. এবার শুনে বললেন, আপনি যান, আরো কমিয়ে আনুন। আপনার উম্মত পারবে না। বনী ইসরাঈলের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। নবীজী বললেন, আমার আর কিছু বলতে লজ্জা হচ্ছে! (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮৮৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬২, ১৬৪)। নবীজীকে যখন বুরাকে তোলা হচ্ছিল তখন বুরাক ঔদ্ধত্য দেখাল। তখন জিবরাঈল আ. বললেন, মুহাম্মাদের ক্ষেত্রে এরকম করছিস! তোর উপর তো এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ কোনোদিন চড়েনি। এ শুনে বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল। (দ্রষ্টব্য : জামে তিরমিযী, হাদীস ৩১৩১)। আল্লাহ তায়ালা নবীজীর জন্য যে বিশেষ উপহার হাউযে কাউসার রেখেছেন প্রথম আসমানে নবীজীকে তা দেখানো হয়। নবীজী সেই কাউসারের বিবরণও দিয়েছেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫১৭)। নবীজী যখন প্রথম আসমানে যান দেখেন এক ব্যক্তি, তার ডান পাশে কিছু রূহ আর বাম পাশে কিছু রূহের কাফেলা। তিনি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বাম দিকে তাকালে কাঁদেন। তিনি নবীজীকে সম্ভাষণ জানালেন। নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল! ইনি কে? জিবরাঈল বললেন, ইনি আদম আ.। আর তার দুই পাশে তার সন্তানদের রূহ। ডান দিকের গুলো জান্নাতী আর বাম দিকের গুলো জাহান্নামী। এজন্য তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন আর বামদিকে তাকিয়ে কাঁদেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৪২)। এ সফরে নবীজীকে জান্নাত-জাহান্নামের ভ্রমণও করানো হয়। নবীজী বলেন, জান্নাতের প্রাসাদগুলো মুক্তার তৈরি আর তার মাটি হল মেশকের। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫১৭)। নবীজী এ সফরে একদল লোককে দেখলেন, তাদের নখগুলো তামার। নিজেদের নখ দিয়ে তারা নিজের গাল ও বুকে আঁচড় কাটছে। জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল, এরা কারা? বললেন, এরা ওই সমস্ত লোক, যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের সম্ভ্রমে আঘাত হানত। অর্থাৎ গীবত করত এবং মানুষকে লাঞ্ছিত করত। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৩৪০; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৭৮)। নবীজী এ সফরে হযরত মূসা আ. ও হযরত ঈসা আ.-এর শারীরিক গড়নেরও বিবরণ দেন। নবীজী বলেন, আমি ইবরাহীমের আকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৯৪)। হযরত ইবরাহীম আ.-এর সাথে মুলাকাত হলে তিনি নবীজীকে বলেন, আপনি আপনার উম্মতের কাছে আমার সালাম পৌঁছাবেন। আর তাদেরকে বলবেন, জান্নাতের মাটি পবিত্র ও সুঘ্রাণযুক্ত, এর পানি সুমিষ্ট এবং এর ভূমি উর্বর ও সমতল।(দ্রষ্টব্য : জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৬২)। এ সফরে নবীজীকে তিনটি উপহার দেওয়া হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামায, সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো এবং এই উম্মতের যারা শিরক থেকে বেঁচে থেকে মৃৃত্যুবরণ করবে তাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়ার ঘোষণা। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৩)। এ সফরে নবীজীর সাথে পূর্ববর্তী নবীগণের সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি নামাযে সকলের ইমামতি করেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭২)। এ সফরে নবীজী দেখলেন, একদল লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? জিবরাঈল আ: বললেন, এরা বক্তৃতা করত বটে, কিন্তু নিজেরা আমল করত না। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২২১১, ১২৮৫৬)। মিরাজ থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতীমে বসা। মুশরিকরা ইসরা ও মিরাজের ঘটনা শুনে উপহাস ও কটাক্ষ করতে লাগল। বিভিন্নভাবে নবীজীর দিকে প্রশ্নের তীর ছুড়তে লাগল। তারা চাইল, বাইতুল মুকাদ্দাসের পূর্ণ বিবরণ শুনবে। নবীজী এমন প্রশ্নে খুবই বিব্রত হয়ে ওঠেন। এত রাতে কি বাইতুল মুকাদ্দাসকে ওরকম নিখুঁত ভাবে দেখতে গিয়েছেন নাকি! নবীজী বলেন, এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমি আগে পড়িনি। আল্লাহ তায়ালা প্রিয় বন্ধুকে সাহায্য করলেন। নবীজীর চোখের সামনে মেলে ধরলেন বাইতুল মুকাদ্দাসের দৃশ্য। নবীজী দেখে দেখে তাদের প্রত্যেকটি জিজ্ঞাসার বিস্তারিত জবাব দিলেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭২)। মিরাজের ঘটনা এবং আমাদের করণীয়: মিরাজের ঘটনা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রতিটি মুমিনের ঈমান ও আবেগ জড়িয়ে আছে এর সাথে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করণীয় আছে।এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে করণীয় তা হচ্ছে, মিরাজের ব্যাপারে সহীহ আকীদা পোষণ করা। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক রাতে সশরীরে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সাত আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত, জাহান্নাম ভ্রমণ করিয়েছেন; আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বড় বড় কিছু কুদরত প্রিয় হাবীবকে দেখাবেন বলে। এটা সীরাতে রাসূলের একটি বড় অধ্যায় এবং নবী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুজিযা। এটা মুসলমানের অকাট্য মৌলিক আকীদার অংশ। অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় তা স্বীকৃত ও সুসাব্যস্ত। তাই এক্ষেত্রে স্বচ্ছ বিশ্বাস রাখা জরুরি। মিরাজ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি বিশেষ মুজিযা। আর মুজিযা ওই ঘটনাকেই বলা হয়, যা সাধারণ সক্ষমতার বাইরে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষভাবে সংঘটিত হয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থায় প্রভাবিত হয়ে অনেকে একে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে চান। এটা ইসলামের এবং ইসলামের দাওয়াতের স্বভাবজাত প্রক্রিয়া নয়। কখনো কখনো এমনসব বৈজ্ঞানিক থিউরি শোনানো হয়, যা অনেক সময় হাস্যকর সাব্যস্ত হয়। তাই ইসলামের বিধিবিধান ও শাআইরগুলোকে ইসলামের স্বভাববোধ থেকে অনুধাবন করা এবং এর মাধ্যমে নিজের ঈমানী যিন্দেগী বিনির্মাণ করাই হচ্ছে প্রকৃত মুমিনের শান বা কর্তব্য। মিরাজের ঘটনা থেকে সরল দাগে যে শিক্ষাগুলো পাওয়া যায় সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ- ১.আল্লাহর সত্তার উপর পূর্ণ ও সঠিক বিশ্বাস রাখা। শিরক থেকে বিলকুল বেঁচে থাকা। ২. আল্লাহর সাথে বান্দার আবদিয়াত তথা দাসত্বের সম্পর্ক মজবুত করা। ৩. নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়া। কেননা এটা মিরাজে লাভ করা উম্মতের জন্য নবীজীর তোহফা। বস্তুত নামায এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে রবের সাথে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় ও মধুময় হতে থাকে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বান্দা যখন নামায পড়ে তখন সে তার রবের সাথে নিভৃতে আলাপ করে। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৫)। ৪. সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলোর শিক্ষা ও মর্মগুলো ধারণ করা। এখানে মুমিনের ঈমানের শিরোনামগুলো সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয়েছে। ৫. আল্লাহর হক ও বান্দার হকের প্রতি যত্নশীল হওয়া। ৬. গীবত ও পরনিন্দা থেকে বেঁচে থাকা। মানুষের সম্ভ্রমহানি না করা। কাউকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত না করা। এটা অনেক বড় কবীরা গুনাহ। ৭. শুধু লম্বা লম্বা বক্তৃতা নয়, খেয়াল করা- মানুষকে যে নসীহত করছি, আমার মাঝে তা কতটুকু আছে। ৮. জান্নাতের ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া। ৯. জাহান্নামের ব্যাপারে ভীত থাকা। ১০. হাউযে কাউসারের প্রত্যাশী হওয়া। ১১. হযরত ইবরাহীম আ. যে দোয়ার কথা বলেছেন-সেই দোয়ার প্রতি মনোযোগী হওয়া। ১২. সকল প্রকার গুনাহ, বিশেষ করে মদ ও গীবত থেকে বেঁচে থাকা। শেষ কথা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেই পবিত্র ও বরকতময় ভূমিতে ইসরা ঘটেছে সেই বাইতুল মুকাদ্দাস আজ তারই উম্মতের জন্য অনিরাপদ এক লীলাভূমি। আজ মুসলমানদের হাত থেকে বেদখল পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস ও জেরুযালেম। সেখানে ভেসে যায় আমার ভাইয়ের রক্ত। কিন্তু তার জন্যে আমার-আপনার হৃদয়ে কতটুকু রক্তক্ষরণ হয়! আন্তরিক ভাবে ভেবে দেখা জরুরি। এছাড়া প্রিয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসরা ও মিরাজ। আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করে বাস্তব ধর্মীয় করণীয় সম্পর্কে আরো বেশি জানা, বুঝা এবং এই শিক্ষাগুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়াই বুদ্ধিমানের পরিচয়।আর তা হলেই আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের হবে ধন্য ও আলোকিত। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন, আমিন।।
লেখক: গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ বিশ্লেষক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান, গাউছিয়া ইসলামিক মিশন কুমিল্লা।