রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে লাইভ সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো ‘জুলাই গণহত্যা’ মামলার প্রধান অভিযুক্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রম। রোববার (১ জুন) দুপুর ১২টার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছে প্রসিকিউশন টিম। শেখ হাসিনা ছাড়াও এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ডিসেম্বরের মধ্যে জুলাই-আগস্টের হত্যাযজ্ঞের বিচার দৃশ্যমান হবে। এ সময়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাবে। বিচার এমনভাবে করা হবে কেউ যেন মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। শেখ হাসিনাকে ‘গুম ও আয়নাঘরের নিউক্লিয়াস’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিচারের কাজ পুরোদমে এগোচ্ছে। তবে তদন্ত শেষ করতে যুক্তিসংগত সময় লাগবে। অভিযোগ দাখিলে যা বলল প্রসিকিউশন টিম : রোববার আদালতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলায় সূচনা বক্তব্য রাখেন। বিচারকদের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আজ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে এই ট্রাইব্যুনালের পবিত্র কক্ষে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন আইনজীবীই নই, ইতিহাসের এক তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে। তিনি বলেন, আমরা এই বিচার শুরু করেছি জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে, যেখানে নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবা, নারী ও শিশু যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটা পদ্ধতি নামক কুপ্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস ও ন্যায়সংগত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ২৪-এর আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিদের কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন। আসামিদের নির্দেশে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা, মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো। আদালতকে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যা ‘মনসুন রেভল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত-সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আসামিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেওয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আসামিরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ওইসব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়। উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়- এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, অন্যান্য বাহিনী এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তাদের অধীন সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে। বিচারকদের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয়, বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অফ দ্য আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য। এই ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আমরা যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করব সেগুলো হচ্ছে- প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিকটিমদের সাক্ষ্য, অপরাধ সংগঠনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ, ড্রোন ও সিসি ক্যামেরা ফুটেজ, আসামিদের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস, ডিজিটাল এভিডেন্সগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি ও ভিডিও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিসিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি। তাজুল ইসলাম বলেন, এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা। আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে, সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে, সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। বিচার শুরুর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের সেই সব ভিকটিমদের যারা আর কোনোদিন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসবে না। স্মরণ করছি তাদেরও যারা এই আন্দোলনে চোখ, হাত, পা কিংবা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়েছেন। স্মরণ করছি সেই সব অকুতোভয় মানুষদের, যাদের অপরিসীম ত্যাগের কারণে এই রাষ্ট্র অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে। তিনি বলেন, এই আদালত এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে, যা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। আমরা চাই এ বিচার হোক নিরপেক্ষ, প্রমাণনির্ভর এবং ন্যায়ভিত্তিক। আমরা চাই এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক, বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ। পাঁচ অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বলছে, তদন্তকালে আসামি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগ ছাড়াও সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। অপরাধ-১ : গণভবনে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ তাদের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা। অপরাধ-২ : আসামি শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন কর্তৃক শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীনস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন। অপরাধ-৩ : রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে সরাসরি নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের ‘বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে’ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা ও অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন। অপরাধ-৪ : ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন। অপরাধ-৫ : ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং এর আশপাশ এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ, যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে।

By তালাশ বাংলা ডেস্ক

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ আক্কাস আল মাহমুদ হৃদয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *